ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন সঠিকভাবে মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের অভাবে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অপরাধীকে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করা হয়েছে।ব্যারিস্টার সাবরিনা জেরিনের সঞ্চালনায় স্বাস্থ্য বিষয়ক অনলাইন মাধ্যম ডক্টর টিভির এক অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন তাদের ভাবনার কথা।
কোনো ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোন ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলে অভিহিত করা হয়। শারীরিকভাবে অন্যকে বলপ্রয়োগ কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে ধর্ষণ সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম কোন অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলন করাও ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয়।
আইনের দৃষ্টিতে ধর্ষণ বলতে কী বলা হয়? -জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে সম্মতিটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, একটি সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্সে সম্মতি ছিল কিনা এটি প্রধান বিষয়। সেখানে যদি সেক্সচুয়াল পেনিট্রেশন ঘটে আমরা সেটাকে ধর্ষণ বলতে পারি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনেক কঠিন। কিন্তু ধর্ষণ কাকে বলবো? সেই ধর্ষণের আইনগত সংজ্ঞার জন্য আমাদেরকে কিন্তু ১৮৬০ সালের ব্রিটিশ আমলের দণ্ডবিধিতে যেতে হচ্ছে। এবং সেখানে যে সংজ্ঞা দেয়া আছে, সেটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে যৌন অপরাধের সংজ্ঞার সাথে একেবারে বেমানান।
তাসলিমা ইয়াসমিন উল্লেখ করেন, পুরনো সংজ্ঞার কারণে ট্র্যাডিশনাল মাইন্ডসেট বা মেডিকেল রিপোর্টের ওপর অসম্ভব জোর দেয়া হয় ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষেত্রে। আর এই মেডিকেল রিপোর্টের মান তখনই বেড়ে যায়, যখন তাতে লেখা থাকে যে ভিকটিমের শরীরে ইনজুরির চিহ্ন আছে বা সে ধর্ষণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। যদি কোন ইনজুরি চিহ্ন বা প্রতিরোধ করার চিহ্ন না থাকে, তাহলে আমরা কিন্তু দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই এটা ভিকটিমের জন্য নেগেটিভ হিসেবে কাজ করে।
ধর্ষণের আলামত কীভাবে নষ্ট হয়?
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিকটিমকে যদি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে আসা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও যদি সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করা যায় তাহলে তার ফল আরও বাস্তবসম্মত এবং প্রচুর আলামত পাওয়া যাবে। আর যদি ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে যায় তাহলে কিছুটা সমস্যা হয়ে যায়, কারণ এই সময়ের মধ্যে গোসলসহ অন্যান্য কাজে পানি ব্যবহার করা হলে তখনই সেই আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
ধর্ষণের ভুক্তভোগীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার মেডিকেল প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়। যাতে আদালতে ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচার কাজ পরিচালনা করতে সুবিধা হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, একজন ভিকটিমকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল এভিডেন্স (প্রমাণ) সংগ্রহ জরুরি। অনেক সময় মামলা করতে বা থানায় যেতে দেরি হয়ে যায়। ভিকটিমকে অবশ্যই থানায় যেতে হবে।
ধর্ষণের বিচারে মেডিকেল রিপোর্ট কতটুকু জরুরি?
মেডিকেল রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নিলুফার সুলতানা বলেন, ডাক্তারের কাছে আসা উচিত। ঘটনা প্রমাণের জন্য অপরাধীর শাস্তির জন্য এটা করা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক ভয়ের কারণে অনেকে আসতে চায় না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে না এসে দুই-তিন দিন পরে আসে। আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন অজস্র রোগী আসছে, তারমধ্যে যৌন নির্যাতনের দ্বারা ভুক্তভোগী বা ধর্ষণের রোগীর সংখ্যাও কম নয়।এসব ভুক্তভোগীদের মধ্যে নারীদের পাশাপাশি শিশুরাও আছে। অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা গর্ভবতী হয়ে আসছে। তাদের বাবা-মা বলছে গর্ভের বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে। আবার দেখা যায় এই শিশুটি গর্ভবতীর হয়েছে সেটা তার বাবা-মা বুঝতেও পারেনি। সে ক্ষেত্রেও আমাদের আলামত সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়।
ধর্ষণ প্রতিরোধে করণীয় কী?
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট পার্থ রায় বলেন, আমাদের শতকরা ৮০ জন ধর্ষক তাদের ভিকটিমকে সরাসরি চেনে এবং ২০ পার্সেন্ট ধর্ষক ভিকটিমদের সরাসরি চেনে না।
তিনি বলেন,শত্রুতার কারণে, ভালোবাসার কারণে, সাইকো সেক্সচুয়াল ডিজঅর্ডার, নিউরো সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার, পার্সনালিটিজ ডিজঅর্ডারের কারণে সেক্সচুয়াল ইন্টারকোর্সে সম্মতি না থাকায় ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ধর্ষণ রোধের জন্য ইলেকট্রিক সুইচে চাপ দিলে চলে যাবে বিষয়টি এমন না। আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে দ্রুতগতিতে আনতে হবে,আইনের প্রয়োগ থাকতে হবে। স্কুল-কলেজগুলোতে ধর্ষণ রোধে কনসালটেন্ট নিয়োগ দিতে হবে।